হযরত ডঃ শেখ আহমাদ পেয়ারা বাগদাদী (রঃ): কিছু স্মৃতি কথা – শাহীদ রিজভী
হযরত ডঃ শেখ আহমাদ পেয়ারা বাগদাদী (রঃ)-কে প্রথম দেখি ১৯৯৩ সালের ২২ এপ্রিল, চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ ময়দানে আন্তর্জাতিক সুন্নী মহা সমাবেশে। সেখানে আল্লামা জুবাইর সাহেবের কালজয়ী বক্তব্য শুনে ডঃ বাগদাদী (রঃ) আল্লামা জুবাইরকে জড়িয়ে ধরেন। আল্লামা জুবাইর এর সেদিনের ভাষণ আমার জীবনে দেখা ও শোনা সেরা ভাষণ। উল্লেখ্য সে মহা সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন আওলাদে রাসুল আল্লামা সৈয়দ সাবের শাহ (মঃজিঃআঃ)। সেখানে আরো বেশ ক’জন বিদেশী মেহমান এসেছিলেন। তাঁরা হলেন আল্লামা ডঃ সলিম উল্লাহ আল ওয়াইসী, আল্লামা আমীর আলী শাহ কাজেমী, পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী জনাব হাজী হানিফ তৈয়ব। আর সেদিনের সুন্নী মহাসমাবেশে বিশেষ আকর্ষণ ছিলো ডঃ বাগদাদী (রঃ) তীর ধনুক নিয়ে এসেছিলেন। তিনি তীর ধনুক এর উপমায় লাইলাতুল মিরাজ রজনীতে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর সাথে হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওআ সাল্লামার পরম মহামিলনের চরম সম্পর্ককে উপস্থাপন করে “ফাকানা কা’বা কাওসাইন আও আদনা”-র গভীর তত্বজ্ঞান সহজ ও প্রাঞ্জল ভাবে বুঝিয়ে দেন আর উপস্থিত দর্শকেরা বিমোহিত হয়ে রাসুল প্রেমে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন।
তার তিন দিন পর ২৫ এপ্রিল ডঃ বাগদাদী (রঃ) চকবাজারে ছাত্রসেনা’র মাহফিলে প্রধান মেহমান হিসেবে তশরীফ আনেন। একই মাহফিলে প্রধান বক্তা ছিলেন আল্লামা জয়নুল আবেদীন জুবাইর। চকবাজার ছিলো জামাত শিবির অধ্যুষিত রাজাকারী গুন্ডাদের অভয়ারণ্য। চকবাজারে ছাত্রসেনা নেতাকর্মীদের এমন একটা দিন কাটেনি যখন আমরা শিবির সন্ত্রাসীদের জুলুমের শিকার হইনি। একারণে আমাদের কেন্দ্রীয়, নগর ও থানা নেতারা বলতেন, “চকবাজার ছাত্রসেনার ছেলেরা কাশ্মীর ও চেচনিয়ার মুজাহিদ।” আমি ছাত্রসেনা চকবাজার ইউনিট এর অর্থ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকায় হুজুরদের বিদায় কালে হাদিয়া বিতরণের দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। অন্যান্য হুজুরদের যাওয়ার সময় সসম্মানে হাদিয়ার প্যাকেট দিয়ে বিদায় জানাই। কিন্তু কিংকর্তব্য বিমূঢ় হলাম দুই হাস্তিকে নিয়ে। উনাদের এতো কম টাকা কেমনে দেই। এই ভেবে একটা কৌশলের আশ্রয় নেই। জুবাইর হুজুরের নাম লিখা প্যাকেটে পাঁচটা একশত টাকা আর আল্লামা বাগদাদী (রঃ)’র নাম লিখা প্যাকেটে দশটা একশো টাকার নোট রেখে প্যাকেট ভারী করেছিলাম। বিদায় কালে ওনারা গাড়ীতে উঠার সময় যেই প্যাকেট হস্তান্তর করতে যাই জুবাইর হুজুর বলে উঠেন, “কি করো বাপু?”। আমার সলাজ জবাব-“হুজুর একটু গাড়ী ভাড়া দিলাম।” তিনি প্যাকেট না খুলে নেড়েচেড়ে বললেন, “গাড়ী ভাড়া এতো মোটা কেন?” আমরা তো আরো লজ্জায় নুয়ে পড়ি। সর্বনাশ প্যাকেট খুললে না জানি আমাদের ইজ্জত যায় যায় অবস্থা। জুবাইর হুজুর প্যাকেট না খুলেই বললেন, “এই টাকা দিয়ে স্কুলের ছেলেদের সুন্নীয়তের বই কিনে দিও”। আর ডঃ বাগদাদী (রঃ)’র দুচোখ ভরা জল। যেন নূরের টুকরো ঝরে পড়ছে। জবানে ঈষদোষ্ণ মুচকি হেসে মধুমাখা কণ্ঠে বললেন, “বাজানরা! আমার দয়াল নবীর উপর দরুদ পড়তে আইয়া হুসাইনী বাগানের ফুলদের থেকে ট্যাকা নিলে কাইল হাশরের ময়দানে আমার দয়াল নবীরে কেমনে মুখ দেখাইতাম?” চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। পাশ ফিরে দেখি সবার চক্ষু টলমল।
তারও প্রায় আট বছর পর ২০০১ সালের ২ কি ৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম অক্সিজেন এর নিকটে শহীদনগর এলাকায় মাহফিলে জুবাইর সাহেব সহ আল্লামা ডঃ আহমাদ পেয়ারা বাগদাদী (রঃ) ওয়াজ করেন। মাহফিলের পূর্বে আমার প্রিয় নেতা সেসময় চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রসেনা’র সভাপতি মহিউল আলম চৌধূরী ভাইসহ আরো কয়েক জন ভাই মিলে হুজুরদের হালকা খেদমত করার নছিব হয় এই অধমের। স্পষ্ট মনে আছে, আল্লামা ডঃ বাগদাদী (রঃ) জুবাইর সাহেবের দিকে আঙুল দেখিয়ে অন্যদের বলছিলেন, “মিয়ারা! তোমরা জাননি? এই জুবাইর ই প্রথম বাঙলার সুন্নীগোরে রাজনীতি শিখাইছে। এর আগে সুন্নীরা রাজনীতি বুঝতো নি?” আর জুবাইর সাহেবকে উদ্দেশ্যে করে বলতে থাকেন-“বাজান! এই পথে তো কাঁটা বিছানো। অনেক ষড়যন্ত্র হইবো। বহুত কষ্ট পাইবা। অনেক জিল্লতী পাইবা, মাগার হাল ছাইড়ো না।” এক পর্যায়ে জুবাইর সাহেব ওনার কাছে দোআর দরখাস্ত করলে তিনি বলে উঠেন- “ভয় পাইও না, আমার দয়াল নবী দেখতাছেন তোমরারে।”
কতো বড়ো মাপের আশেকে রাসুল (দরুদ) ছিলেন তা পরিমাপ করা এই ক্ষুদ্র আমার পক্ষে অসম্ভব। সেদিন চকবাজার মাহফিলে করা ওনার ওআজের কিছু চুম্বকাংশ এখনো স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করে ভাসছে। মাহফিল স্থলের এক থেকে দেড় বর্গ মাইলের মধ্যে চট্টগ্রাম কলেজ, মহসীন কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল ও দারুল উলুম আলীয়া মাদরাসা অবস্থিত। প্রতিটা প্রতিষ্ঠান জামাত শিবিরের অভেদ্য দূর্গ, ক্ষেত্র বিশেষে মিনি ক্যান্টনমেন্ট। হুজুর সব জেনে বুঝে হুমকির মুখেও মাহফিলে আসতে পিছপা হননি। নবীজীর নূর হওয়া, সৃষ্টিজগতের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া ইত্যাদি গভীর জ্ঞানের তত্বকথা সুন্দর সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন। এখনো চোখের সামনে সমুজ্জ্বল হয়ে ভাসছে- “বাজানরা! আমার দয়াল নবীর নূরের খেলা কী বুঝবা? কাফেরের মেশিনের নূরের ঠেলাই তো বুঝো না! বিশ্বাস করো, আমার ভাইগ্না আমেরিকা থাকে। একটা চিঠি লেইখা To- Pir Mama Ahmed Peyara Bagdadi লেইখা একটা মেশিনের পেটের ভিতর ঢুকাইয়া দিলো। আর এক মিনিটের মইধ্যে হাজার হাজার মাইল দূরে ঢাকায় আইসা আরেকটা মেশিনের পেটের মইধ্য থাইকা বাহির হইয়া গেলো। মাঝখানে Ocean আছে, Degert আছে, Mountain আছে, Jungle আছে। কিছুই তারে আটকাইতে পারলো না। কী জানো বাবা মেশিনটার নাম? এফ এ এক্স- ফ্যাক্স FAX. বানাইছে কে? কাফের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করছে। তো বাজানরা কাফেরের এই মেশিনের নূরের ঠেলা বুঝলা না। আমার দয়াল নবীর নূরের খেলা কী বুঝবা। আমার দয়াল নবীর সাথে বেআদবি কইরো না। হালাক (ধ্বংস) হইয়া যাবা।”
তিনি তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু মৌমাছির স্পারম নিয়ে সুরা নাহল থেকে কিছু কথা ব্যাখ্যা করেন। আর “ফাদখুলি ফি ইবাদি ওআদখুলি জান্নাতি” – এই আয়াতে করীমার সুন্দর ব্যাখ্যা করে বলতে থাকেন, “মিয়ারা! এত্তো বছর একটা ক্ষুদ্র জীব মৌমাছির এক বিন্দু বীর্য নিয়া Research কইরা পিএইচডি নিলাম। লোকে আমারে ডক্টরেট কয়। এখনো তো মৌমাছির বীর্যের জ্ঞান পূর্ণ করতে পারি নাই, দয়াল নবীরে কেমনে চিনতাম? তিনি যে পুরা সৃষ্টি জগতের মূল কেন্দ্র বিন্দু। বাবারা আমার দয়াল নবীর গোলামীর শেকল পরো। আউয়াল আখেরে নাজাত পাইবা।” সেদিন চকবাজারে তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনে কিছু শিবির ক্যাডার তাওবা করেন আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাআত এর আক্বিদা ভূক্ত হন।
কতো বড়ো মাপের একজন আধ্যাত্মিক সাধক, অন্যদিকে বিশ্বমানের একজন জ্ঞান তাপস!! ভাবা যায়? চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে মৌমাছির স্পারম এর উপর গবেষণা করে “রেডিয়েশন বায়োলজি”র মতো একটা কঠিন সাবজেক্ট নিয়ে পিএইচডি করেন। অধ্যাপনা করেছেন বিশ্বের নামকরা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে। ক্ষুদ্র মুখে বড় কথা বলি- বঙ্গদেশে জন্ম হেতু ও প্রাকটিক্যাল মুসলিম হবার কারণেই নোবেল পুরষ্কার পাননি। এতো বড়ো বিশ্ব মানের ব্যক্তিত্ব হয়েও মা, মাটি ও মাতৃভাষা ভোলেননি। মাহফিল গুলোতে ও আলোচনায় দেখেছি সহজিয়া সারল্যে ভরা আঞ্চলিক ভাষার বাহুল্য লক্ষ্যণীয় ছিলো বটে।
আজ গা শিউরে উঠে- আল্লামা জুবাইরকে নিয়ে করা এই অলিউল্লাহর ভবিষ্যত বাণী কিভাবে অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেলো!!!
কুমিল্লা গেলে বেশ ক’বার সেনা নেতা কর্মীদের নিয়ে তাঁর মাজার শরীফ জিআরত করার সুযোগ হয়েছে। সস্ত্রীক ও গিয়েছি। এক পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা শান্ত সবুজ পাড়া গাঁয়ে বিশ্রামরত আছেন সৌম্য সুন্দর মহান পুরুষ। জিয়ারত করার সময় অজান্তেই চোখের জল ঝরে পড়ে। সেনা নেতা কর্মীরা বিলাপ করতে থাকে। আর অধম বলতে থাকি- আজ সুন্নীয়তের বিভেদ আক্রান্ত সময়ে দয়াল নবীর কোলে গিয়ে এতো শান্তভাবে কেমনে শুয়ে আছেন। আপনার সুন্নীয়তের সোনালী বাগান তছনছ হয়ে যায়। আপনার সবুজ বিপ্লব আজ হিংসা ও বিদ্বেষের হলদে বিষে আক্রান্ত। হে শেখ! উঠে আসুন। আপনার “হুসাইনী ফুল” গুলো আজ অভিভাবক শূণ্য। এ ময়দানে যে আজ আপনাকে বড় প্রয়োজন।
মনের গভীরে অনুরণন ঘটে। যেন তিনি ডাক দিয়ে যান- “ভয় পাইও না, আমার দয়াল নবী দেখতাছেন তোমরারে।”
~~~লেখকঃ শাহীদ রিজভী, অর্থ সম্পাদক, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ
[related_post themes="flat" id="777"]