ভুলে যাওয়া ইতিহাসঃ বেদনাময় উপাখ্যান- বালাত আল শুহাদা–শাহীদ রিজভী
বালাত আল শুহাদা যা ইংরেজিতে The battle of the court of martyrs (আরবি: معركة بلاط الشهداء, মারাকাত বালাত আস-শুহাদা) নামে বিখ্যাত এক করুণ উপাখ্যানের কথা বলছি আজ। ১১৪ হিজরী সনের ২য় রমজান। দক্ষিণ ফ্রান্স এর দুটি শহর “পোইটিয়ার্স” এবং “ট্যুরস” এর মধ্যবর্তী অঞ্চলে ঘটে যাওয়া এক ঐতিহাসিক রক্তক্ষয়ী অসম যুদ্ধের নাম। ইসলামি ইতিহাসে এটি ‘বালাতুশ শুহাদা’ যুদ্ধ নামে পরিচিত। ৭৩২ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর, রোজ শনিবার এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধটি শাবানের শেষ দশক থেকে শুরু করে রমাদ্বানের প্রথম দিন পর্যন্ত দশ দিনের জন্য অব্যাহত ছিল। মুসলিম বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল ৭০ থেকে ৮০ হাজার। খ্রিস্টান বাহিনী ছিল চার লাখ! মুসলিমদের সেনাপতি ছিলেন আন্দালুসের উমাইয়া গভর্নর, ইসলামি ইতিহাসের অমিততেজা বীর আবদুর রহমান আল গাফিকি। খ্রিষ্টানদের সেনাপতি ছিলেন শার্লে মার্শেল। আরবিতে ‘বালাত’ অর্থ প্রাসাদ। ‘শুহাদা’ শব্দটি ‘শহীদ’ এর বহুবচন। এ যুদ্ধে মুসলমানদের এত লাশ পড়েছিল যে, এগুলোকে একত্রিত করলে একটি প্রাসাদ হয়ে যেত! কারও কারও মতে, সে প্রান্তরে একটি পাকা মহাসড়ক ছিল বলে, এ-কে “বালাতুশ শুহাদা“ যুদ্ধ বলা হয়।
শার্লে মার্শেল এর পর্বতসম বাহিনীর কিছু ছিল ঘোড়সওয়ার আর কিছু ছিল পদাতিক। এদের শরীরে ছিল নেকড়ের চামড়ার পোশাক। ঘাড় পর্যন্ত লম্বিত চুল। যা জট পাকানো ছিল। এদের ভাবমূর্তি দেখলেই পিলে চমকে যাবার মতো ছিল! শার্লে মার্শেল লয়ার নদী পার হয়ে, নদীকে পেছনে রেখে অবস্থান নিলেন। যুদ্ধের প্রথম আটদিন উভয়পক্ষে হালকা সংঘর্ষ হয়। এতে মুসলমানদের পাল্লা ভারি ছিল। কিন্তু নবম দিনে সংঘটিত হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। দিনভর যুদ্ধ চলে। অবশেষে রাতের আঁধার নেমে এল। এবারও মুসলমানদের পাল্লা ভারি ছিল। দু’পক্ষ পৃথক হয়ে গেল। আরও একটু সময় যুদ্ধ স্থায়ী হলে মুসলমানরাই জেতার সমূহ সম্ভাবনা ছিল।
পরদিন শনিবার। যুদ্ধের দশম দিন। আবারও যুদ্ধ শুরু হলো। বিজয় মুসলমানদের পদচুম্বন করতে যাবে, ঠিক তখনই শোরগোল উঠল যে, গনিমতের মালসহ মুসলমানদের সেনাছাউনি বিপদের সম্মুখীন! দুশমনেরা সেখানে হামলা করেছে! এতে দুর্বলচিত্তের বার্বারি মুসলিম সেনারা গনিমতের মাল রক্ষার্থে ময়দান ছেড়ে ছাউনি অভিমুখে ছুটল। মুসলিম বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে গেল। আবদুর রহমান আল-গাফিকি সেনাদের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সব প্রচেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এতক্ষণে মুসলিম বাহিনীর অবস্থা একেবারে শোচনীয় আকার ধারণ করেছে। বীরের মতো লড়াই করে যেতে লাগলেন গাফিকি। তবুও অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজি নন তিনি। হঠাৎ করে শাঁ করে এসে দুশমনের একটা তীর তাঁর পায়ে বিদ্ধ হয়। ঘোড়ার পিঠ থেকে তিনি ছিটকে পড়লে শত্রুরা নির্মমভাবে আঘাত করে। সেখানেই শাহাদাত বরণ করেন।
দুটি বিপদের সম্মুখীন হয় মুসলিম বাহিনী। এক. নিজেদের বিশৃঙ্খলা। দুই.সেনাপতির শাহাদাতে নেতৃত্বশূণ্যতা। ব্যস, তাদের মনোবল ভেঙে যায়। এই সুযোগে খ্রিষ্টান বাহিনী হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। মুসলমানদের লাশের পর লাশ ফেলে সামনে এগোতে থাকে। তবে এত বিপদের মধ্যেও কিছু দৃঢ়চিত্তের মুজাহিদ নিজেদের তরবারির নৈপুণ্য দেখান। চরম বিপদের মুহূর্তেও মুসলমানদের বাহুবল কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারে খ্রিষ্টানরা। একসময় রাতের অন্ধকার নেমে আসে। উভয়পক্ষ ছাউনিতে ফিরে যায়।
মুসলিম বাহিনী ছাউনিতে পৌঁছে একে অন্যের ওপর দোষারোপ করতে লাগল। এমনকি একে অন্যের দিকে হাতিয়ার পর্যন্ত উঠিয়ে নিল! ফরাসিদের ওপর এখন বিজয়ের আশা সম্পূর্ণ দুরাশায় পরিণত হলো। এখন নিরাপদে সরে পড়াই একমাত্র বিকল্প রাস্তা। তাই সে রাতের আঁধারেই মুসলিম বাহিনী সেপটিমানিয়ার দিকে পথ ধরল।
সকাল হলে মুসলিম ছাউনিতে সব চুপচাপ দেখে শার্লে মার্শেল ও তার মিত্র ইউডিস মুসলমানদের কোনো নতুন কৌশল মনে করে সন্দিহান হয়ে পড়লেন। তারা সন্তর্পণে জানতে পারলেন যে, মুসলিম বাহিনী সরে গেছে, আর কিছু আহত সহযোদ্ধাদের ফেলে রেখে গেছে সেখানে। কালবিলম্ব না করে তারা মুসলিম বাহিনীর ছাউনিতে পৌঁছে আহত সেনাদের হত্যা করে ছাড়ে। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে বালাতুশ শুহাদা যুদ্ধের!
ইউরোপের কলিজায় ফ্রান্সে সংঘটিত এই ‘টুরস’ বা ‘বালাতুশ শুহাদা’ যুদ্ধে অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় আন্দালুসের আরব ও বার্বারি মুসলিম বাহিনী। কিন্তু সে যুদ্ধে মুসলমানরা জিতলে কী হতো? ধারণা করা যায়? তাহলে শুনুন- বালাতুশ শুহাদা যুদ্ধে মুসলমানরা জিতলে আজ ইউরোপের ইতিহাস ভিন্নভাবে রচিত হতো। ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিক গিবন ও লেনপুলদের মতে, সে যুদ্ধে মুসলমানরা জিতলে প্যারিস ও লন্ডনে, ক্যাথলিক গির্জার পরিবর্তে গড়ে উঠত মসজিদ। অক্সফোর্ড ও অন্যান্য শিক্ষাকেন্দ্রে বাইবেলের পরিবর্তে শোনা যেত কুরআনের বাণী!
ট্যুরের যুদ্ধ বা শহীদের প্রাসাদ বা মহাসড়কের যুদ্ধে , ফ্রাংক ও বুর্গুন্দীয় সৈন্যদের সাথে আরব উমাইয়াহ খিলাফতের সেনাবাহিনী পরাজিত হলে পশ্চিম ইউরোপে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা ব্যহত হয়। এটি ছিল এক অর্থে ইউরোপের প্রাণকেন্দ্রের বেশ কাছে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের এক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। দু’পক্ষের শক্তি, হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি অজানা। তবে ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে মুসলিম সেনাবাহিনীর সংখ্যা প্রায় ৮০,০০০ ও খ্রিস্টানদের এর বহুগুণ বেশি বলে উল্লেখ করেছে। হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতিতেও মুসলমানদের সম্ভবত ১০ থেকে ১২ হাজার এর মধ্যে শহীদ হন; অপরদিকে খ্রিস্টানদের ১৫০০ প্রাণহানি ঘটে বলে জানা যায়।
অনেক ইতিহাসবিদ এই যুদ্ধের ফলাফলকে ইউরোপের খ্রিস্টানদের জন্য এক যুগান্তকারী ঘটনা বলে উল্লেখ করেন। তাদের মতে এই যুদ্ধে খ্রিস্টানরা পরাজিত হলে গোটা ইউরোপের ইসলামীকরণের সম্ভাবনা ছিল এবং তা হলে ইউরোপের ইতিহাসই পাল্টে যেত। আবার কেউ কেউ মনে করেন মুসলমানরা ইউরোপের জন্য এত বড় হুমকি ছিল না এবং এই যুদ্ধের ফলাফল কেবল পশ্চিম ইউরোপের শক্তিশালী ক্যারোলঙ্গীয় ফ্রাংক রাজবংশের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি নির্দেশ করে।
পুনশ্চ: ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে উগ্র খ্রিস্টান কর্তৃক অর্ধশতাধিক মুসল্লি হত্যায় সন্ত্রাসী হামলায় ব্যবহৃত রিভলভারের গায়ে লেখাগুলোর মধ্যে ‘টুরস ৭৩২’ ও ‘শার্ল মার্টেল’ লেখার মধ্য দিয়ে বুঝা যায় ১৩শ বছর আগের বালাত আল- শুহাদার চেতনা মুসলমানরা লালন করতে না পারলেও বিরোধীরা টুরসের চেতনা ঠিকই লালন করেছে! ১৩শ বছর আগের শার্ল মর্টেলের চেতনা নিয়ে ব্রান্ডন ট্যারন্টরা উজ্জীবিত থাকলেও, শহীদ আবদুর রহমান ইবনে আবদুল্লাহ আল গাফিকির চেতনায় উজ্জীবীত হবার মতো মুসলিম এ যুগে আর নেই!
—————————————
ইনসেটেঃ ছবিতে বালাত আল শুহাদা যুদ্ধে মুসলিম সেনাপতি শহীদ আবদুর রহমান আল গাফিকী যুদ্ধরত অবস্থায় পায়ে তীরবিঁদ্ধ দেখা যাচ্ছে।
সূত্রাবলীঃ
১- The Andalusian History, from the Islamic conquest till the fall of Granada 92–897 A.H. (711–1492 C.E.), by Professor AbdurRahman Ali El-Hajji, a professor of the Islamic history at Baghdad University, published in Dar Al-Qalam, in Damascus, and in Beirut. “2nd Edition”. p. 193-194
২- ﻓﺠﺮ ﺍﻷﻧﺪﻟﺲ -২২৭, ড. হুসাইন মুআন্নিস।
৩- ﺍﻟﺘﺎﺭﻳﺦ ﺍﻷﻧﺪﻟﺴﻲ -১৯৭, ড. আবদুর রহমান আল-হাজি।
৪- ﺑﻼﻁ ﺍﻟﺸﻬﺪﺍﺀ -৪৪, শাওকি আবু খলিল।
৫- উইকিপিডিয়া.
_______________________
অনলাইন অবলম্বনে অনুলিখনঃ
মুহাম্মদ শাহীদ রিজভী,
আইনজীবী ও সমাজকর্মী।
২ রমদ্বান, ১৪৪২ হিজরী।
বৃহস্পতিবার, ঢাকা।