প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে অপ্রতুল বরাদ্দঃ পূনর্মূল্যায়ন আবশ্যক –অধ্যক্ষ ইব্রাহীম আখতারী
গত ৩ জুন’ ২০২১ইং জাতীয় সংসদে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল ২০২১-২২ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেট পেশ করেন। তাঁর প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যেটিকে এযাবতকালের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ অংকের বাজেটই বলা যায়। এটি হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদের ৩য় ও করোনাকালীন ২য় বাজেট। প্রস্তাবিত বিশালাকারের এ বাজেটে শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট ৭১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা । তন্মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ২৬ হাজার ৩১১ কোটি টাকা, মাধমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় ৯ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ০৮ ভাগ। শিক্ষা খাতে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ আছে ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ ও জিডিপির ২ দশমিক ০৯ ভাগ। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের তুলনায় এবারকার বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ অপেক্ষাকৃত ৫ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা বেশি। কিন্তু জিডিপির হিসেবে তা অপেক্ষাকৃত কম। যা শিক্ষার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের জন্য মোটেও যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ মহল। এ কথা অনস্বীকার্য যে, শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতি ও সাফল্যই দেশের সমৃদ্ধির সোপান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। শিক্ষা ব্যবস্থার গতিশীলতার ক্ষেত্রে কোনরূপ ব্যত্যয় ঘটলে জাতীয় লক্ষ্যার্জন সুদুর পরাহতই হয়ে থাকবে। যৎকারণে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ থাকলেও স্বাধীনতা পরবর্তী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার কর্তৃক শিক্ষা খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। ফলে ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের ঘোষিত ৭৮৬ কোটি টাকা মাত্র এর বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ১৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। যা ছিল বাজেটের ২২ শতাংশ। এছাড়াও শিক্ষা খাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এর মাধ্যমে শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে যে কোন দেশের শিক্ষা খাতের বাজেট মোট বাজেটের ন্যূনতম ১৫-২০% বা জাতীয় আয়ের ৪-৬% হওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের ন্যুনতম ২০ শতাংশ বা জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের বিষয়টি উল্লেখিত থাকলেও এক্ষেত্রে যোজন দূরত্বে রয়েছে বাংলাদেশ। এখনও জাতীয় বাজেট তথা জিডিপি উভয় ক্ষেত্রে প্রদত্ত বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের অর্ধেক বা অর্ধেকের চেয়ে সামান্য বেশি। এছাড়াও ইউনেস্কো একটি সুস্থ, সুন্দর ও শিক্ষিত দেশ গড়ার জন্য বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ন্যূনতম ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া অধিকতর যৌক্তিক বলে মনে করে। কিন্তু অত্যন্ত দূঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে এযাবতকাল পর্যন্ত শিক্ষা খাতে বরাদ্দ সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৫ বা ৬ শতাংশ অতিক্রম করে নি। ফলশ্রুতিতে শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অপরাপর দেশের চেয়ে অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ। এক পরিসংখ্যান মতে জ্ঞান সূচকে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভূটান, ভারত ও পাকিস্তান এসব রাষ্ট্রও বাংলাদেশের শীর্ষে। উচ্চশিক্ষা কিংবা প্রাথমিক শিক্ষার দিক থেকেও বাংলাদেশের অবস্থান আরও নিম্নগামী। এ নেতিবাচক পরিণতির জন্য শিক্ষা খাতে অপ্রতুল বরাদ্দই অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিদগ্ধ মহল। যাইহোক, জিডিপির ৪ শতাংশের নিচে বরাদ্দ রেখে শিক্ষায় উন্নত হয়েছে বিশ্বের এমন কোন দেশের দৃষ্টান্ত আছে বলে মনে হয়না। অথচ শিক্ষা খাতের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষণা ও উন্নয়ন নামেও পৃথক একটি খাতের অস্থিত্ব দৃশ্যমান হয়। বিশ্বের প্রায় ১২৫টির মতো দেশ এ খাতে প্রতি বছর অন্তত এক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। অনুসন্ধানে জানা যায়, যারা এ খাতে যত অধিক ব্যয় করেছে, তারা তত বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। এ তালিকায় নেপাল এর মত একটি দেশ এর সম্পৃক্তি লক্ষ্যনীয় হলেও বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কেননা বাংলাদেশে এ খাতে বরাদ্দের কোন প্রভিশনও নেই। যাইহোক, সুদীর্ঘ প্রায় দেড় বছর যাবত কোভিড-১৯ করোনা নামক অদৃশ্য ভাইরাসের অশুভ শিকারে পরিণত হয়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে। অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছে শিক্ষা খাত। বিগত ১৬ মাস যাবত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে, শিক্ষা ক্ষেত্রে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয়ের উৎসসমূহ শ্লথ হয়ে যাওয়ায় তাদের সন্তানদের লেখাপড়াসহ জীবন-জীবিকা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাই এমনিতর কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ মহামারিতে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এ খাতে প্রদত্ত বরাদ্দ মোটেও সন্তোষজনক নয় বলে মনে করি। করোনার কারণে পারিবারিক অর্থ সংকট, বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি, লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়া, অপুষ্টিজনিত প্রতিবন্ধকতা ও বাল্যবিবাহের কারণে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ক্ষেত্রে বিগত দুই দশকে যে অগ্রগতি হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের মতে তা ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হবে বলে সমূহ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সুতরাং এহেন কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাহিদা এবং অধিকারের বিষয়টুকু বিবেচনায় নিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে শিক্ষা খাতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার আবশ্যকীয়তা রয়েছে। করোনা বিপর্যয় থেকে শিক্ষাব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে যেসব বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা বাঞ্ছনীয় ছিল এবং এসবের আশু বাস্তবায়নে যে পরিমান বরাদ্দের দরকার, তা প্রস্তাবিত বাজেটে উপেক্ষিত হয়েছে। সত্যিকার অর্থে এবারকার ঘোষিত বাজেটে জীবন ও জীবিকাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে শিক্ষা খাত গুরুত্ব হারিয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার কোন জো নেই যে, প্রস্তাবিত বাজেট যতটুকুন ব্যবসা বান্ধব ততটুকুন শিক্ষা সহায়ক হয়নি।
বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ যৎসামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই। তবে এর একটি বড় হিস্যা ব্যয় হয়ে থাকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতন-ভাতার পশ্চাতে। সুতরাং অতিরিক্ত বরাদ্দটা কার্যতঃ ইতিবাচক কোন কাজে আসবে বলে মনে হয়না।
এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো, করোনাকালীন এ দুঃসময়ে দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার। সুতরাং এটি বাস্তবায়িত হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের জন্য “মরার উপর খাঁড়ার ঘা” তে পরিণত হবে। উপরন্তু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে।
বাজেটে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এ খাতের প্রদত্ত বরাদ্দ মাত্র ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। অথচ এক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত যুবকদের চাহিদা বিবেচনা করে স্বল্পমেয়াদী কোর্সের ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেয়া উচিত। এছাড়াও কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসারকল্পে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণসহ বিদেশীদের চাহিদা অনুযায়ী যোগ্য ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলাও আবশ্যক। সুতরাং মানবসম্পদ বিনির্মাণে শিক্ষা খাত যদি অবহেলিত হয়, তাহলে কোনপ্রকার উন্নয়নই টেকসই হবে না। এমনকি বাজেটের মূল লক্ষ্যও ব্যাহত হবে। তাই শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। উপরন্তু এবারকার বাজেটে বিভিন্ন সরকারি ব্যয় ও বরাদ্দের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন পূর্বক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করাই অধিকতর যৌক্তিক।
লেখকঃ অধ্যক্ষ এম ইব্রাহীম আখতারী
প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিবিদ
ই-মেইলঃ mdibrahimakhtari@gmail.com
সূত্রঃ ২৮ জুন ‘২১ইং দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকার ২য় পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রবন্ধ।
[related_post themes="flat" id="1640"]