শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য—– কলামিস্ট অধ্যক্ষ এম ইব্রাহীম আখতারী
বিশ্ব ইতিহাসের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি বাংলাদেশ। এটি বাঙালির রক্তমূল্যে কেনা একটি মহাঅর্জন। যেটির আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে অসংখ্য-অগণিত বেদনাবিধুর স্মৃতি। যার নেপথ্যে রয়েছে, ৩০ লক্ষ বাংলা মায়ের অকুতোভয় মর্দে মুজাহিদদের অমূল্য প্রাণ বলিদান এর মত কীর্তিগাঁথা। কেবলই তা নয়, এটি হচ্ছে ২ লক্ষ মুক্তিকামী মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মত কলঙ্কজনক এক ট্রাজেডি। এছাড়াও এক্ষেত্রে রয়েছে “বুদ্ধিজীবী হত্যার” মতো জঘন্যতম নির্মম ও ন্যাক্কারজনক বিষয়টিও। যেটি ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কোনভাবেই উপেক্ষিত হবার নয়। ১৯৭১ সালের সুদীর্ঘ ৯ মাসের অবিরাম সশস্ত্র যুদ্ধে পাক হানাদাররা যখনই বাঙালির চুড়ান্ত বিজয়ের প্রসববেদনা টের পেলো, তখনই জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ ও দেশের অগ্নিগর্ভা সন্তান বুদ্ধিজীবীদের নির্বিচারে হত্যায় মেতে উঠে। পাকিস্তানের মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এদেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করে। যে ধারাবাহিকতায় ১৪ ডিসেম্বরের এ দিনে সর্বাধিক সংখ্যক বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল। নাতিদীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এত বুদ্ধিজীবীর জিবনাবসান ২য় বিশ্বযুদ্ধ ব্যতীত অন্য কোথাও সংঘটিত হয়েছে বলে মনে হয়না। পাক দুঃশাসন- অপশাসন এর বিরুদ্ধে যেসব বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন সোচ্চার কন্ঠ, যাঁরা স্বীয় জ্ঞানজ্যোতি বিচ্ছুরিত করে জাতিকে আলোর পথ প্রদর্শন করেছেন, মূলতঃ তাঁরাই হয়েছিলেন হানাদার বাহিনীদের অবাঞ্ছিত টার্গেট। অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এ লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞে নির্লজ্জভাবে পৃষ্টপোষকতা করে তাদের এদেশীয় দোসর কমবখত রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। তারা এদেশের অসংখ্য চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, গবেষক, সাংবাদিক ও কবি-সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করে। অতঃপর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন পরবর্তী ঢাকার মিরপুর, রাজারবাগ ও রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে তাদের ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ দৃশ্যমান হয়।বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদ এই দিনকে ‘ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস” হিসেবে ঘোষণা করেন। অতঃপর ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে এটি “শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস” হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু অত্যন্ত দূঃখজনক হলেও সত্য যে, যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হলেও বাংলাদেশে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্রীয় কোন সঠিক তালিকা নেই। তবে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ছিল মোট ১ হাজার ৭০ জন। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর সরকার শহীদ বুদ্ধিজীবীর একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত বছরের ১৩ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রাথমিক তালিকা চূড়ান্ত করেছে। এতে ১২২২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়। তবে স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরে এতদসংক্রান্ত সম্পূর্ণ তথ্য প্রমাণ নাও থাকতে পারে, আবার অনেকের স্বজনেরা বেঁচে নেই, বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছেন
অনেকে। তাই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ একটি তালিকা করা খুবই কঠিন বলে মনে করেন বিদগ্ধজনরা। সত্যিকার অর্থে স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করাই ছিল এ পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের মূল প্রতিপাদ্য। এদেশের মেধাবী মানুষদের হত্যা করে এদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল তারা। অথচ জালিম পাক হানাদার বাহিনীর এহেন ধারণা -চিন্তাকে অসার প্রমাণিত করে দিতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ এখন ভিন্ন চেহারায় দৃশ্যমান। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অপ্রতিরোধ্য এক শক্তি বাংলাদেশ। বেশ কিছু অবাক করা সাফল্যে দেশের অর্জনের ঝুরি অধিকতর সমৃদ্ধ। যেমন – ২০১৫ সালের জুলাই মাসে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পা রাখার সক্ষমতা অর্জন করে এদেশ। উপরন্তু ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রাথমিক স্বীকৃতিও লাভ করে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৮.১৫ এ উন্নীত হয়েছে। শুধু তাই নয়, উন্নয়ন-অগ্রগতিতে দক্ষিন এশিয়ায় অনেক সূচকে ভারত-পাকিস্তান থেকেও এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ এর জাতীয় বাজেট এখন ৬ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। বিশ্বব্যাংক এর সাথে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে সমর্থ হয় এদেশ। যা সত্যিকার অর্থে বিস্ময়ের বিস্ময়। ইতোপূর্বে যে বাংলাদেশ বিশ্ব পরিমণ্ডলে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিল অথচ আজ সেই বাংলাদেশ তাবৎ দুনিয়ায় উন্নয়নের রোল মডেল। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় উল্লেখযোগ্য আরও কিছু বিষয়ের উল্লেখ করতে হয়। যেমন-বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপন, সমুদ্র সীমা অর্জন, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ,পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, নারীর ক্ষমতায়ন, ঢাকা মেট্রো রেল প্রকল্প বাস্তবায়ন, প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিঃশর্ত আশ্রয় প্রদান, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, রপ্তানী আয় বৃদ্ধি ও পর্যটন শিল্পের বিকাশ প্রভৃতি ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক কিছু। যাইহোক, কালের ধারাবাহিকতায় এবারও বাঙালির জাতীয় জীবনে সমাগত এ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এ প্রেক্ষাপটে এদেশের মানুষের দাবী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জড়িত সকল অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করা। এক্ষেত্রে কতিপয় শীর্ষ অপরাধীর বিচার ও শাস্তি কার্যকর হয়েছে বটে। তবে যারা অদ্যাবধি বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে আছে কিংবা পলাতক রয়েছে তাদের রায় কার্যকর করে দেশকে কলংকমুক্তক করা আবশ্যক বলে মনে করি। এ মহান দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। পাশাপাশি তাঁরা যে উন্নত ও সমৃদ্ধ একটি দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে পথ ধরেই সম্মুখপানে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। এটিই হোক শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অঙ্গীকার।
সূত্রঃ১৪ ডিসেম্বর ‘২১ ইং দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ।
[related_post themes="flat" id="1769"]