দুর্ভিক্ষের প্রমাদ গুনছে পাকিস্তানঃ ক্ষমতাচক্র, আমলাতন্ত্র ও জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতিই দায়ী
দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ পাকিস্তান। যেটি স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৪৭ সালে। বিশ্ব তালিকায় যার রয়েছে ৩৪তম বৃহত্তম দেশের খ্যাতি। যেথায় রয়েছে ৯৮ শতাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের আবাস। এটি বিশ্বের জনবহুল দেশ হিসেবে ৬ষ্ট স্থান দখল করে আছে। উপরন্তু এশিয়ার এককালের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী রাষ্ট্র পাকিস্তান। অথচ নিয়তির কি নির্মমতা- হাল সময়ে দেশটি অনাকাঙ্ক্ষিত দেউলিয়াত্বকে আলিঙ্গন করছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশটির জাতীয় অর্থনীতি। ক্রমাগত অর্থনৈতিক সংকটে খেই হারিয়ে ফেলেছে পাকিস্তান। সম্প্রতি সেদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খোয়াজা আসিফ এক সভায় পাকিস্তান দেউলিয়া হয়ে গেছে এবং আমরা একটি দেউলিয়া দেশে বাস করছি বলে এমনটি মন্তব্য করেন। অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো, পাকিস্তানে এখন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী সাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বহির্ভূত হয়ে পড়েছে। যার অশুভ শিকারে পরিণত হয়ে অনাহারে- অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে অনেকেই। জনজীবনে বিরাজ করছে ত্রাহি অবস্থা। মূল্যস্ফীতি জটিল আকার ধারণ করেছে। এমনকি প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে এখন ২৭৭ রুপিতে। দেশে মজুদ সামগ্রীও একেবারে তলানিতে। ক্ষেত্র বিশেষে টাকা দিয়েও পণ্য প্রাপ্তি দুরূহ হয়ে পড়েছে। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য গগনচুম্বী। শুধু তাই নয়- গ্যাস সিলিন্ডারের মূল্যও বর্ধিষ্ণু। যৎকারণে মানুষ এখন ঝুঁকিপূর্ণাবস্থায় প্লাস্টিকের ব্যাগে গ্যাস ভরতে বাধ্য হচ্ছে। পেট্রোল পাম্প সমূহের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে ভোক্তাদের সুদীর্ঘ লাইন। জ্বালানি সংকটের তীব্রতায় অধিকাংশ মিল-কারখানা ক্রমশঃ বন্ধ হয়ে পড়ছে। গ্যাস সংকটের দরুন সিংহভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পতিত হয়েছে তামাম দেশ। অপ্রতুল বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে হাসপাতালগুলোতেও অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছে চিকিৎসা ব্যবস্থা। ঔষধ সামগ্রীও সহজলভ্য নয়। উল্লেখ্য, গেল বছর পাকিস্তান ভয়াবহ বন্যার অশুভ শিকারে পরিণত হয়ে দেশটির অধিকাংশ তুলা শস্য নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দেশটির তুলা বুনন শিল্পেরও খুবই শোচনীয় অবস্থা। যা দেশটির অন্যতম আয়ের উৎস। পাকিস্তানের টেক্সটাইল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী এ শিল্পে কর্মরত প্রায় ৭০ লক্ষ শ্রমজীবি মানুষ চাকরি হারিয়েছে। মিনি টেক্সটাইল ও টেক্সটাইল পণ্য যেমন বিছানার চাদর, তোয়ালে এবং ডেনিম উৎপাদনকারী অনেক কারখানা তুলা সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে। অধিকন্তু টেক্সটাইল শিল্পে বর্ধিত করারোপ গোদের উপর বিষফোড়ায় পরিণত হয়েছে। রিজার্ভ সংকটের কারণে এখন টেক্সটাইল পণ্যের কাঁচামাল, চিকিৎসা সামগ্রী এবং খাদ্যপণ্য আটকে আছে করাচি বন্দরে। এমতাবস্থায় পাকিস্তানের পুরোনো বিশ্বস্ত মিত্র চীন-সৌদি আরবও দেশটিকে আগলে রাখতে চাচ্ছে না। এ কঠিন পরিস্থিতিতে তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমনকি পাকিস্তানে চীনা অর্থে নির্মিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বিপরীতে দীর্ঘদিনের কিস্তি অপরিশোধিত থাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে চীন। অপরদিকে অবিশ্বাস্যভাবে হ্রাস পেয়েছে পাকিস্তানি মুদ্রার মূল্য। উপরন্তু বৈদেশিক মুদ্রার সংকটজনিত কারণে দেশটির আমদানি কার্যক্রম থমকে গেছে। বন্দরসমূহতে দৃশ্যমান হচ্ছে খালি কন্টেইনার এর স্তুপ। ক্রমাগত কর্মহীন হয়ে পড়ছে অসংখ্য-অগণন মানুষ। মুদ্রাস্ফীতিও শুন্যরেখা অতিক্রম করেছে। পাকিস্তানে চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসেই মুদ্রাস্ফীতির গড় হার ৩৩ শতাংশে ঠেকেছে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের সাহায্যেও যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয় বলে মত ব্যক্ত করেন অর্থনীতিবিদরা। দেশটি এমনিতর একটি নেতিবাচক পর্যায়ে পতিত হয়েছে- সেদেশের একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী জনগণকে চা খাওয়া থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করেছেন। কেননা চা কিনতে যে পরিমান ডলারের প্রয়োজন তাও নাকি তাদের নেই। এমনকি বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ কর্তৃক সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহ ভূমিকম্পে লণ্ডভণ্ড তুরস্ক ভ্রমণের প্রাক পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। যাইহোক, ক্ষমতাসীন শেহবাজ শরিফ সরকার দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আই এম এফ) এর নিকট প্রথম কিস্তিতে ১.১ বিলিয়ন ঋণের জন্য দ্বারস্থ হয়। এতে মুখ ফিরিয়ে নেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আই এম এফ)। কারণ এ মূহুর্তে পাকিস্তানের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নেই বললেই চলে । যেহেতু ইতোমধ্যে দেশটির রিজার্ভ এর পারদ ৩ বিলিয়ন ডলারের নিম্নে অবস্থান করছে। যা দিয়ে দেশটি বিদেশ থেকে তিন সপ্তাহের বেশি পণ্য আমদানি করতে পারবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ মহল। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ইমরান খান সরকারের আমলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৬.৫ অর্থাৎ সাড়ে ছয় বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদানের প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছিল । কিন্তু দেশটিতে অর্থনৈতিক বিপর্যয় অব্যাহত থাকায় তাও আটকে যায়। বলাবাহুল্য,পাকিস্তানকে আগামী এক বছরে ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আর আগামী সাড়ে তিন বছরে ৮ হাজার কোটি ডলার ঋণ শোধ করার বাধ্য বাধকতা রয়েছে দেশটির। অন্যথায় অবাঞ্ছিত দেউলিয়া তকমা এড়ানো কোনভাবেই সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিদগ্ধ মহল। আর পাকিস্তান যেভাবে ঋণভারে নুইয়ে পড়েছে, তাতে এহেন ভয়াবহ অবস্থা থেকে উত্তরণে আপাতত কোন পজিটিভ সিমটম পরিলক্ষিত হচ্ছে না। উপরন্তু চীন কর্তৃক পাকিস্তান এর উপর ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ অব্যাহত রাখায় দিশেহারা প্রায় পাকিস্তান। কেননা পাকিস্তানের মোট ঋণের ৩০ শতাংশ নেয়া হয়েছে চীন থেকে। পাকিস্তান কর্তৃক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে পূনঃ সময়সীমা নির্ধারণের অনুরোধ করলেও চীন তা প্রত্যাখ্যান করে। অথচ চীনের ঋণ পরিশোধ করতে সৌদি আরব ও আমিরাত থেকে নতুন করে ঋণ নিতে হয়েছে পাকিস্তানকে। পাকিস্তানের এ সংকটের জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খোয়াজা আসিফ কোন রাখঢাক না রেখে প্রকাশ্য সভায় সে দেশের রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী এবং আমলাতন্ত্রকেই দোষারোপ করেছেন। তিনি এমনটিও অভিযোগ করেন যে, পাকিস্তানে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি ছাড়াও সংবিধানের প্রতিও কেউ নাকি ভ্রুক্ষেপ করে না। এছাড়া বিগত ৩২ বছর ধরে সেদেশের রাজনীতির মান কেবলই নিম্নমূখী বলেও দাবি করেন তিনি। যাইহোক, এটি অস্বীকার করার কোন জো নেই যে,পাকিস্তান নামক এ রাষ্ট্রে কখনও শতভাগ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দৃশ্যমান হয়নি। দেশটিতে প্রায়শঃ বিরাজমান থাকে রাজনৈতিক অস্থিরতা। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার ৭৬ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও দেশটিতে পূর্ণমাত্রার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা প্রত্যক্ষ করেনি বিশ্ববাসী। তন্মধ্যে দেশটি সরাসরি সামরিক শাসনাধীনে ছিল ২৫ বছর এবং অবশিষ্ট ৫১ বছরের মধ্যে গণতন্ত্রের উর্দি পরিহিত যাঁরা ছিলেন, মূলতঃ তাঁরাও ছিলেন অন্তরালে সামরিক জান্তার আশীর্বাদপুষ্ট। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এযাবতকালের ২৩ জন রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে কেউই পূর্ণমেয়াদে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারে নি। যৎকারণে কখনো দেশটিতে সামরিক বাহিনীর স্বার্থের ওপরে জনস্বার্থ প্রাধান্য পায়নি। ফলশ্রুতিতে দেশটির সকল সরকারই অর্থ-সম্পদকে জাতীয় উন্নয়নের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত প্রতিরক্ষা খাতে ব্যবহারে মনোযোগ নিবিষ্ট করে বেশী। আর এমনই সব কারণে ক্রমাগত মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায় দেশটির। অতঃপর দেশটি ধীরে ধীরে শ্রীলংকার পথেই হাটছে বলে প্রতীয়মান হয়। যাইহোক, এটি কোনভাবেই বিস্মৃত হবার নয় যে, বিগত বছর প্রায় একই কারণে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হয় দক্ষিন এশিয়াভুক্ত রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে না পেরে এবং জনগণের তোপের মুখে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছিল সেদেশের প্রেসিডেন্ট। যে দেশটিকে তুলনা করা হতো ইউরোপের সাথে। অথচ সে দেশটি এখন গলায় জড়িয়েছে দেউলিয়া নামক সাইনবোর্ড। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, শূন্য ভাণ্ডার দিয়ে বাংলাদেশ এর অভিযাত্রা হলেও মাত্র ৫১ বছরে অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রায় সকল সূচকেই পাকিস্তানের অনেক শীর্ষে অবস্থান করছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ভারত থেকেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশের টাকা পাকিস্তানি রুপির চেয়ে বর্তমানে আড়াই গুণের বেশি শক্তিশালী। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর মতে বাংলাদেশ এখন ৩৫তম অর্থনীতির দেশ। ২০৩০ সালে ২৫তম এবং ২০৪১ গিয়ে দাঁড়াবে ২১তম দেশে। পাকিস্তানে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ, গৃহীত অসম ঋণের যথার্থ ব্যবহারে অদূরদর্শিতা এবং অব্যাহত রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশটিকে এহেন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। আর শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্দিষ্ট একটি পরিবারের আধিপত্য বিস্তৃতি, অপরিকল্পিত মেগা প্রকল্পের বিপরীতে গৃহীত ঋণের সদ্ব্যবহারে উদাসিনতা এবং দেশের জনগণের প্রয়োজনের প্রতি নিঃস্পৃহ থাকায় তাদের এ করুণ দশা। অতএব, বাংলাদেশকে বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে কেবলই আত্মতুষ্টির ঢেকুর তুললে যথেষ্ট হবে না। নিম্নোক্ত বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। যেমন – দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অবাধ চর্চা অব্যাহত রাখা, নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা, আমদানী নির্ভরতা কমানো, অপরিকল্পিত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকা, মন্ত্রী-এমপিদের ছুতোনাতায় রাষ্ট্রীয় সফর সংকুচিত করা, সর্বোপরি রপ্তানী আয় ও রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধিতে জোর দেয়াসহ অভিশপ্ত দুর্নীতির মূলোৎপাটনে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে হবে। অন্যথায় এযাবতকালের সকল অর্জনই ম্লান হয়ে যাবে।
—কলামিস্ট অধ্যক্ষ এম ইব্রাহীম আখতারী
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সূত্র: দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশিত কলাম(২২ মার্চ ২০২৩ ইং)